নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা
অর্থ আত্মসাৎ ও পাচারের অভিযোগে ২০২২ সালের ১৪ মে ভারতে গ্রেফতার হয়েছেন বাংলাদেশের আলোচিত ব্যবসায়ী প্রশান্ত কুমার হালদার ওরফে পি কে হালদার। এরপর থেকে তিনি অর্থপাচার মামলায় ভারতের কারাবাসে রয়েছেন। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে অন্তত দশ হাজার কোটি টাকা নিয়ে দেশ থেকে পালিয়েছেন তিনি। তবে মুদ্রার উলটা পিঠে উঠে আসলো ভয়ংকর এক তথ্য। দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী গ্রুপ এস আলম গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ নিজেদের কুকর্ম লুকাতে তাকে দেশত্যাগে বাধ্য করে। এমনকি দেশে থাকাকালীন তাকে ডিজিএফআইয়ের টর্চার সেলে নেয়ার চেষ্টাও করা হয়। এমন পরিস্থিতিতে তিনি দেশত্যাগে বাধ্য হন। পরবর্তীতে সে যেন তার নিজের হাতে গড়ে তোলা প্রতিষ্ঠানসমূহকে ধ্বংসের জন্য গ্রুপটির জোর-জবরদস্তিমূলক কর্মকান্ডের কথা কাউকে বলতে না পারে সেজন্য তাকে কৌশলে ভারতীয় ইডির (এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট) মাধ্যমে গ্রেফতারও করিয়ে দেয় চট্টগ্রাম ভিত্তিক এই গ্রুপটির কর্ণধার। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কাছে পিকে হালদারের পক্ষ থেকে পাঠানো এক চিঠিতে এমনটা দাবি করা হয়।
দুদক সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের শুরুর দিকে দুদকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে পি কে হালদারের পক্ষে একটি চিঠি পাঠানো হয়। এতে তার দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার নেপথ্যে এস আলম গ্রুপের সঙ্গে ব্যবসায়ীক দ্বন্দের কথা উল্লেখ করা হয়। দাবি করা হয়, এস আলম গ্রুপের কর্নধার নিজের চুরি লুকাতে পিকে হালদারকে সকলের সামনে অপরাধী বানিয়েছেন। সেই সঙ্গে চিঠিতে আর্থিক কেলেঙ্কারির সঙ্গে পি কে হালদারের কোন সম্পৃক্ততা ছিলো কিনা সে বিষয়ে পুরো অবস্থান তুলে ধরা হয়।
পি কে হালদারের পক্ষে পাঠানো সে চিঠিতে দাবি করা হয়, ২০১৯ সালে দুদক অনুসন্ধানের আগে-পরে কখনোই কানাডায় যাননি পি কে হালদার। বরং সে বছরের ২২শে অক্টোবর ভারতে যান তিনি। তার দু’দিন পরেই চট্টগ্রামভিত্তিক এই ব্যবসায়ী গ্রুপের কর্ণধারের সঙ্গে দেখা করতে সিঙ্গাপুর যান এনআরবি গ্লোবালের সাবেক এই ব্যবস্থাপনা পরিচালক। এরপর বেশ কিছুদিন মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডে ঘোরাঘুরির পর পি কে হালদার আবার ভারতে ফিরে যান এবং সেখানেই অবস্থান করেন। ভারতে অবস্থানকালে নিজের গড়ে তোলা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান চালিয়ে নেয়ার জন্য দেশে ফিরতে চান। এ জন্য ২০২০ সালে উচ্চ আদালতের দ্বারস্থও হন পি কে হালদার। আদালত প্রথমে তার পক্ষে আদেশ দিলে তিনি দেশে ফেরার লক্ষ্যে ভারত থেকে দুবাই যান। সেখানে গিয়ে তিনি দেশে ফেরার জন্য টিকিটও কাটেন। তবে পরে শুনতে পারেন আদালতের আদেশটি তার বিপক্ষে চলে গেছে। তাই সে আর দেশে ফিরতে পারেনি।
চিঠিতে আরো দাবি করা হয়, চট্টগ্রামভিত্তিক এই ব্যবসায়ী গ্রুপের কর্ণধারের কৌশলের কারণেই পি কে হালদার দেশে ফিরতে ব্যর্থ হয়েছেন। এসব কিছু তিনি প্রথমে বুঝতে পারেন নি। পরবর্তীতে কর্ণধারের পরামর্শে ভারতীয় পাসপোর্ট সংগ্রহ করেন ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের সাবেক এই এমডি। তবে তিনি ভারতে আসার পর ব্যবসায়ী গ্রুপটির কর্ণধারই সর্বোচ্চ ক্ষমতা প্রয়োগ করে তাকে গ্রেফতার করিয়েছেন। পরবর্তীতে গ্রেফতার হওয়ার পর পিকে হালদার যেন কোন ধরনের বিরূপ মন্তব্য করতে না পারেন সেজন্য কর্ণধারের ছোটভাই ভারতে গিয়ে ব্যবস্থা করে আসেন।
কী নিয়ে এস আলমের সঙ্গে দ্বন্দ্ব?
পি কে হালদারের পক্ষ থেকে পাঠানো চিঠিতে এস আলম গ্রুপের কর্ণধারের সঙ্গে তার দ্বন্দ্বের কথা উল্লেখ করা হয়। বলা হয়, পি কে হালদার মেধাবী একজন ব্যক্তি। তার মেধা যোগ্যতার কারণেই বেক্সিমকো গ্রুপ, ইন্টারন্যাশনাল লিজিংসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ঊর্ধ্বতন পদে চাকরি পান। এ ছাড়া তার মেধা ও যোগ্যতা দেখেই চট্টগ্রামভিত্তিক এই শিল্পগোষ্ঠীর কর্ণধার তাকে রিলায়েন্স ফিন্যান্স লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে চাকরি দেন। প্রায় ছয় বছর ধরে প্রতিষ্ঠানটিতে তিনি চাকরি করেন। পরবর্তীতে ওই ব্যবসায়ী গ্রুপের কর্ণধারই পি কে হালদারকে এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের এমডি হিসেবে দায়িত্ব দেন। ২০১৮ সাল পর্যন্ত তিনি ব্যাংকটিতে দায়িত্ব পালন করেন। পরে নিজেই ব্যবসা শুরু করেন। ২০১৮ সালের শেষদিকে তাকে ওই ব্যবসায়ী গ্রুপের কর্ণধার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছেড়ে দিতে চাপ দিতে থাকেন। সে সঙ্গে পি কে হালদারের সব ব্যবসা সম্পত্তি তার নামে লিখে দেয়ার জন্যও চাপ সৃষ্টি করেন।
চিঠিতে আরো দাবি করা হয়, ২০১৯ সালে ক্যাসিনো বিরোধী অভিযানের সময় দুদকের তালিকায় প্রভাব খাটিয়ে কৌশলে এই ব্যবসায়ী গ্রুপের কর্ণধার পি কে হালদারের নাম ঢুকিয়ে দেন। এক্ষেত্রে এস আলম গ্রুপকে সহায়তা করেন দুদকের সাবেক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ। পরে ইকবাল হোসেন এবং এস আলম গ্রুপের কর্ণধারের ঘনিষ্ঠ একজনের পরামর্শে ভারতে চলে যান এনআরবি গ্লোবালের সাবেক এই এমডি। যদি দেশত্যাগ না করতেন তাহলে পি কে হালদারের জীবননাশও হতে পারতো বলে দাবি করা হয় ওই চিঠিতে।
ইন্টারন্যাশনাল লিজিং নিয়ে অভিযোগ ও নেপথ্যের ঘটনা
দুদকে পাঠানো চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, ফাস ফাইন্যান্স এবং ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের সম্মিলিত পোর্টফোলিও ৫ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। প্রচার করা হয়েছে এর পুরো অর্থই পিকে হালদার নিয়ে গেছেন, যা ভিত্তিহীন। ইন্টারন্যাশনাল লিজিং থেকে পিকে হালদার তার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ গ্রহণ করেছে সত্য। তবে তার সিংহভাগ এস আলমের কোম্পানি রিলায়েন্স ফাইন্যান্সের অনুকূলে বন্টন করা হয়েছে। কিন্তু রহস্যজনকভাবে বাংলাদেশ ব্যাংক এবং দুদক বিষয়টিকে এড়িয়ে গেছে। পিকে হালদার তার যেসব প্রতিষ্ঠানের নামে তখন ঋণ নেয়, সেগুলোর বেশিরভাগই তখন লাভজনক ছিল এবং বাংলাদেশে দৃশ্যমান ব্যবসা পরিচালনায় ছিল। যেমন- নদার্ন জুট, রহমান কেমিক্যাল, আনান কেমিক্যাল, কে এইচ বি সিকিউরিটিজ, ব্র্যান্ডিশন ব্লু কক্সবাজার ইত্যাদি। তা সত্বেও প্রচার করা হয় পিকে হালদার এ কোম্পানির অর্থ বিদেশে পাচার করেছে। মূলত দুদক অনুসন্ধান শুরুর আগ পর্যন্ত অন্তত ১৩টি কোম্পানি এবং পুঁজিবাজার ও জমিতে পিকে হালদারের বিনিয়োগকৃত অর্থের পরিমান ছিলো ২ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। এর অর্থ এই যে বিদেশে পাচার নয়, দেশেই ব্যবসা সম্প্রসারণের লক্ষ্য ছিলো পিকে হালদারের।
বিআইএফসির লুটপাটের নেপথ্যে কারা?
বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফিন্যান্স কোম্পানির (বিআইএফসি) মোট পোর্টফোলিও ৮১৯ কোটি টাকা। প্রচারনা করা হয় এ কোম্পানিটি থেকে ২ হাজার কোটি টাকা সরিয়েছে পিকে হালদার, যা ভিত্তিহীন বলে উল্লেখ করা হয় দুদকে দেয়া চিঠিতে। এতে বলা হয়, মেজর (অব:) মান্নান যখন কোম্পানিটির দায়িত্বে ছিলেন তখন তিনি তার সানম্যান গ্রুপের নামে এখান থেকে ৬৪০ কোটি টাকা নেয়। এর বাইরে বিশ্বাস গ্রুপ ২০ কোটি টাকা, টি কে গ্রুপের ম্যাং নিউজপ্রিন্ট ২০ কোটি টাকা, সিক্স সিদ্ধানস ১৭ কোটি, মাস্টার্ড ট্রেডার্স ১৬ কোটি, রাইজিং গ্রুপ ১৩ কোটি এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের নামে আরো ৯৬ কোটি টাকা নেয়া হয়। এভাবে বিআইএফসির পোর্টফোলিওর পুরো অর্থই লুটপাট করে নেয় গুটিকয়েক সুবিধাভুগী প্রতিষ্ঠান। এমন সময়ে কোম্পানিটিকে সুস্থ করতে এর দায়িত্ব নেয় পিকে হালদার। বিআইএফসি থেকে পিকে হালদারের কোন প্রতিষ্ঠানের নামে কোন ঋণ নেয়া হয়নি।
পিপলস লিজিং নিয়ে পিকে হালদারের অবস্থান
দুদকে দেয়া চিঠিতে দাবি করা হয়, পিকে হালদার যখন পিপলস লিজিংয়ের দায়িত্ব নেয় তখন সে দেখতে পায় প্রতিষ্ঠানটির অবস্থা এতটাই নাজেহাল যে পরিচালনা করা অসম্ভব প্রায়। প্রতিষ্ঠানটি ২০১৫ সালের পূর্বের পরিচালনা পর্ষদের হাতেই ধ্বংস হয়ে গেছে। এমন পরিস্থিতিতে পিকে হালদার বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে প্রতিষ্ঠানটিকে ঠিক করার জন্য একটি স্কীম পেশ করে। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক তার স্কীম আমলে না নিয়ে প্রতিষ্ঠানটির ২০১৫ সালের পূর্বের চেয়ারম্যান ক্যাপ্টেন (অব:) মোয়াজ্জেম হোসেনসহ পর্ষদের সদস্যদের দায়ী করে ২০১৯ সালের জুলাই মাসে হাইকোর্টে কোম্পানিটিকে অবসায়নের জন্য মামলা দায়ের করে। পিকে হালদার এ কোম্পানিটি থেকে কোন ঋণ গ্রহন করেনি। তা সত্বেও প্রচার করা হয় তিনি কোম্পানিটি থেকে ৩ হাজার কোটি টাকা নিয়ে গেছেন। অথচ বাংলাদেশ ব্যাংক পিকে হালদার এবং তার কোন লোকের সংশ্লিষ্টতা না পাওয়ায় তাকে এবং তার সময়ের পর্ষদ সদস্যদের কাউকেই মামলায় বিবাদী করেনি।
আনান কেমিক্যাল কাগুজে নাকি অস্থিত্ব ছিলো?
ইন্টারন্যাশনাল লিজিং থেকে পিকে হালদার সংশ্লিষ্ট যে কয়টি কোম্পানিকে ঋণ দেয়া হয়েছে তার মধ্যে আনান কেমিক্যাল অন্যতম। প্রচার করা হয়েছে এটি একটি কাগুকে কোম্পানি। তবে ২০২০ সালের আগ পর্যন্ত কোম্পনিটির কারখানায় উৎপাদন সক্রিয় ছিল। ওইবছর দুদকের হস্তক্ষেপে কোম্পানিটি কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। চলতি বছরের ৩মে ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের বর্তমান চেয়াম্যান নজরুল ইসলাম খানের (সাবেক শিক্ষাসচিব) নেতৃত্বে আদালতের অনুমোদন সাপেক্ষে কোম্পানিটির কার্যক্রম পুনরায় শুরু হয়েছে। পিকে হালদারকে প্রধান আসামী করে দায়ের করা মামলাটির সময় আনান কেমিক্যালের ঋণটি খেলাপি ছিল না, বরং এটি একটি রেগুলার ঋণ ছিল। এ কোম্পানির নামে মোট বিতরণকৃত ঋণের পরিমান ছিল ৬৩ কোটি টাকা। যার মধ্যে মামলা দায়েরের সময় পর্যন্ত ৪০ শতাংশ বা ২৫ কোটি টাকা পরিশোধ করা হয়। এখানে অবাক করার বিষয় এই যে পিকে হালদারকে এ ঋণের জন্য প্রধান আসামী করা হলেও ঋণটি তার নামে অনুমোদন হয়নি। এ ঋণের টাকা যেসব অ্যাকাউন্টে লেনদেন হয়েছিল সেসব সুবিধাভুগীদের নাম চিন্থিত করার মাধ্যমে এজহার ও চার্জশীটে উল্লেখ থাকলেও তাদের বিরূদ্ধে কোন মামলা দায়ের করা হয়নি।
এ বিষয়ে ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের বর্তমান চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম খান বলেন, (…) ঋণটি এস আলম পরিবারের কারো নামে নেয়া কিনা এমন প্রশ্নও করতে হবে।